ত্রিপুরা জেলার (বর্তমান কুমিল্লা) দায়িত্ব পেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ ডগলাস খুবই চিন্তিত! করুণ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারনে ইংরেজদের চোখে ভারতবর্ষের গ্রামগুলোর সবুজ সৌন্দর্য খুব একটা ধরাপরতো না। কিন্তু কোন এক অজানা কারনে ত্রিপুরায় পৌঁছেই ডগলাস মুগ্ধ হয়ে গেলেন। গ্রামের শান্তরুপ আর মানুষজনের সরলতা তার মনে বিরাট কর্মস্পৃহা জেগে উঠলো। ত্রিপুরাকে ভালবেসে ত্রিপুরা সংস্কারের কাজে আটঘাট বেধে নামেন। পরিকল্পনা কর্মসূচীর মাঝে ছিল রাস্তাঘাট নির্মাণ, রাজধানীর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে অফিস সংস্কার সর্বোপরি একটি সুন্দর স্বয়ংসম্পূর্ণ শহর গড়ার অভিপ্রায়। ক্রমে সেই কর্মসূচী বিশাল আকার ধারন করে যার বাস্তব রুপায়নে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। ব্রিটিশ রাজকোষ থেকে এই মুহূর্তে এত অর্থ একসাথে অনুদান হিসেবে পাওয়া সম্ভব নয় বলে জানতে পারলেনডগলাস। তাই বলে থেমে থাকবে কাজ!!!!! রাতদিন ভেবে একটি উপায় বের করলেন।

ত্রিপুরা জেলায় ছোট বড় অনেক জমিদার ছিলেন। জমিদাররা সবাই তাদের প্রতিপত্তি জাহির করতে সদা ব্যস্ত থাকতেন। কেউ নিজে অনেক পত্নি-উপপত্নী রেখে, কেউ সন্তানদের বিয়েতে খরচ করে, কারও ছিল তালুকের পর তালুক কেনার বাতিক, কেউ স্বয়ং মহারানীকে উপহার পাঠাতেন। কাঙ্গালি ভোজ, কবুতর উড়ানো, ষাঁড়ের লড়াই আর বিড়ালের বিয়েও ছিলোও কারও শখ।ছোটবড় সব জমিদার কাছে এক সকালে মিঃ ডগলাসের পত্র গেলো। কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য সবার কাছে ঋণ চাওয়া হল। সরকারী অনুদান পেয়ে ঋণ যথাসময়ে ফেরত দেবার অঙ্গীকারও ছিল। কিন্তু কেউই এগিয়ে আসলেন না মাতৃভূমির কাজে!!!! সবাই ভাবলেন ব্রিটিশ সরকার ফেরত দেবে ঋণ!!! অকল্পনীয় ব্যপার। জমিদার সাম্নির কাছেও ডগলাসের পত্র এসেছিলো। সভায় নায়েব তা নিয়ে আলোচনাই করলেন না। যদিও সাম্নি নিজে সব কাজের সিদ্ধান্ত নিতেন। প্রবল বিচক্ষন এবং ব্যক্তিত্বময়ী এই নারীর কথাই শেষ কথা বলে বিবেচিত হতো। সভা শেষে সাম্নি নিজে এই পত্র নিয়ে বসলেন। নিজের মনে গভীর হিসাবনিকাশ করলেন এবং পরিকল্পনাটিতে শুধুই জনগণের মঙ্গল দেখতে পেলেন। অর্থের অপচয় হবে কিনা বা ঋণের অর্থ ফেরত আসবে কিনা তা ভেবেও দেখলেন না, নির্দ্বিধায় কর্মসূচীর পুরো অর্থ ডগলাসের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। হতভম্ব ডগলাস প্রথমবারের মত জানতে পারলেন দাতা একজন নারী জমিদার!!! এত এত প্রভাবশালী পুরুষ জমিদাররা যেই কাজের মূল্যায়ন করতে পারেননি, সেখানে একজন বিচক্ষণ নারীর উপস্থিতি সেই সময়ে উনি আশা করতে পারেননি।

সাম্নির অর্থে আর ডগলাসের তত্তাবধানে দ্রুত কাজ এগিয়ে চললো। ইতোমধ্যে সাম্নির আরও অনেক মহৎ কাজের কথা ডগলাস জানতে পারলেন। লোকমুখে জানতে পারলেন সাম্নি অসম্ভব রূপবতী। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ও বিচক্ষণ হওয়ায় তৎকালীন সমাজে ভাই থাকার পরেও সাম্নির হাতেই তার মা আফরান্নেসা জমিদারীর ভার তুলে দেন। যা সেই আমলে অনেক নিন্দিত ছিলও। এই মহৎ হৃদয়ের নারীর জমিদারীর হালহাকিকত সম্পর্কে জানা এবং স্বচক্ষে দেখার অভিপ্রায় ছিলও ডগলাসের কৃতজ্ঞ মনে। তাই কাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ঋণের টাকা পরিশোধের উদ্দেশ্যেনিজে জমিদার বাড়ি আসলেন ডগলাস। পর্দার অন্তরাল থেকে সাম্নি অভিবাদন জানান ডগলাসকে তার কাজের জন্য। তখনও ডগলাস জানতেন না তার জন্য কত বড় চমক অপেক্ষা করছে!!! সাম্নি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে ডগলাসকে জানিয়ে দেন যে সাম্নি কখনি ভালকাজের জন্য ঋণ দেন না, যা দেন তা নিঃস্বার্থ দান হিসেবে দেন। উপমহাদেশের এই নারীর বিচক্ষনতায় ডগলাস মুগ্ধ ছিলেন, এবার তিনি এই নারীর উদারতায় বিস্মিত হলেন। তৎকালীন বেশীরভাগ জমিদাররা যেখানে ভোগবিলাস, উপরওয়ালাদের তৈলমর্দন আর অন্য জমিদারদের সাথে রেষারেষিতে ব্যস্ত থাকতো সেখানে এরকম জনহিতৈষী নারী জমিদারের দেখা পাওয়া সত্যিই বিরল!!

ডগলাসের মনে সাম্নির উদারতা দাগ কেটে যায় এবং এই ঘটনা তিনি মহারানী ভিক্টোরিয়াকে জানান।এই বিদুষীকেউপযুক্ত সম্মানে ভূষিত করতে মহারানীকে অনুরোধ করেন। ইংল্যান্ডশ্বরী সাথে সাথেই এই মহীয়সীকে সম্মাননা প্রদানের নির্দেশ দেন। সেই সময়ে“নওয়াব” ছিল ব্রিটিশদের দেয়া ভারতীয়দের জন্য সর্বোচ্চ সম্মান!!